প্রবাসী_মামার_বউ_

 



                         প্রবাসী_মামার_বউ_


রাতের নিস্তব্ধতা যেন পাহাড়ের গায়ে জমে থাকা কুয়াশার মতোই ভারী হয়ে উঠেছিল। গাড়ির ভেতরে শীতল বাতাসের মধ্যে আরিয়ানের নিঃশ্বাস ভারি হয়ে উঠেছে। সামনের সিটে বসে থাকা মামী এখনো ঘুমিয়ে। তার মাথা হেলান জানালায়, মুখে শান্তি, কিন্তু শরীর যেন কাঁপছে ভিতরে ভিতরে। আরিয়ান তাকিয়ে থাকে মামী’র দিকে। এতটা কাছাকাছি থেকেও যেন দূরত্ব হাজার মাইল। একটা ফোন বের করে সে বারবার স্ক্রিন দেখে—শেষ কলটা এসেছে অচেনা এক নম্বর থেকে। তারপর হঠাৎ, নীরবতা ভেঙে কেঁপে ওঠে ফোন। একটি মেসেজ— “তাকে বিশ্বাস করো, কিন্তু চোখ বন্ধ কোরো না। তোমার দৃষ্টি যেন হয়ে ওঠে তার ছায়া।”

পাহাড়ি পথের নিচের দিকে একটি ছোট কেবিনে গরম চায়ের কাপে ঠোঁট ছুঁইয়ে বসে আছেন এক অপরিচিত লোক। তার চোখে গভীর দৃষ্টি। শরীরে পুরনো চামড়ার জ্যাকেট, দাড়িতে সময়ের ধুলো। তার নাম—নিরব। সাঈদ ভাই এসে ঢুকলেন। বললেন “তুমি বলেছিলে, তুমি তাকে চেনো?”

নিরব মাথা নেড়ে বললেন, “তাকে শুধু চিনি না, ভালোবেসেছিলামও। কিন্তু সে ভালোবাসতে জানে না। সে জানে কেবল বাঁচতে, নিজের মতো করে। তুমি ফিরে এসেছো কেন? নিরব একটু হাসলেন, “কারণ এবার তার নাটকের শেষ দৃশ্য আমি লিখব।”

রাতের একান্ত সময়। রিসোর্টের সেই পুরনো কেবিন। আরিয়ান আর মামী একে অপরের মুখোমুখি। ছোট একটি হিটার চলছে, বাইরের ঠান্ডা থেকে একটু উষ্ণতা আনার জন্য। মোমবাতির আলোয় মামী’র মুখ আবছা। ঠোঁটে হালকা হাসি। কিন্তু সেই হাসির তলায় চাপা আছে কষ্ট—নাকি ধোঁকা? “তুমি এখনো বিশ্বাস করো আমি তোমার পক্ষে?” মামী বললেন।

আরিয়ান চুপচাপ তাকায় তার দিকে। “বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝে একটা রেখা আছে, মামী,” সে বলে, “আর সেই রেখা পেরোনো মানে হয় মুক্তি, নয় মৃত্যু। মামী উঠে এসে তার কাঁধে হাত রাখলেন। তুমি জানো না, আমি কী হারিয়েছি। তুমি দেখেছো শুধু আমার মুখ, আমার শরীর। আমার ভিতরটা দেখোনি কোনোদিন। আরিয়ান ধীরে তার কপালে চুমু দেয়। “তোমার ভিতরটা যদি আগুন হয়… আমি তাও পুড়ে যেতে রাজি।” কিন্তু সে জানে, এই আগুনে শুধু সে না—আরও কেউ পুড়েছে, পুড়বে…

রাত গভীর। আরিয়ান নিঃশব্দে উঠে মামী’র ব্যাগ থেকে পুরনো সেই পেনড্রাইভ বের করে। কিন্তু এবার সে দেখে, নতুন একটি ভিডিও যুক্ত হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়— মামী একজন লোকের সঙ্গে কথা বলছেন। তার মুখ অন্ধকারে ঢাকা। “তুমি প্ল্যান বদলে দিয়েছো, নীরা। কারণ সে বিশ্বাস করে আমাকে। তাকে শেষ করা আমার জন্য কঠিন। তাহলে আমি শেষ করবো। “না!” মামী চিৎকার করে, “ওর গায়ে হাত দিলে… আমি নিজেই তোমাকে শেষ করব।” আরিয়ান ভিডিও বন্ধ করে দেয়। বুক ধকধক করছে। নীরা? এই নাম সে কখনো শোনেনি।

পরদিন সকালে নিরব আর সাঈদ ভাই পাহাড়ি পথ ধরে নিচে নামছেন। সে তোমাকে কী করেছিল?” সাঈদ জিজ্ঞাসা করেন। নিরব হেসে বলেন, “সে একসময় বলেছিল, আমি তার ‘পাহাড়ের আশ্রয়’। তারপর হঠাৎ এক রাতে, সে আমাকে ফাঁসিয়ে দিল এক খুনে। আমি ছিলাম পলাতক দশ বছর। তুমি তাকে খুন করতে চাও? নিরব থেমে যায়। চোখে হালকা জল। আমি শুধু চাই, ও জানুক—ভালোবাসা যেমন বাঁচায়, তেমনি ধ্বংসও করতে পারে।


রাতে আরিয়ান ও মামী আবার মিলিত হয়। এইবার আর শুধুমাত্র শরীর নয়—চোখে চোখে নীরব প্রতিজ্ঞা। মামী বলে, “তুমি চাইলে আমি সব ছেড়ে দেবো। তোমার সঙ্গে দূরে চলে যাবো। আরিয়ান বলে, “আমরা যেখানেই যাই, আমাদের ছায়া আমাদের পেছনেই থাকবে।” তাদের শরীর জড়িয়ে পড়ে একে অপরের মাঝে। শ্বাসের নিচে চাপা পড়ে বহু না বলা কথা। বাতি নিভে যায়… কিন্তু জানালার বাইরে পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে কেউ। নিরব 

সকালের আলো ভাঙতেই গাড়িতে বের হয় তারা। মাঝপথে কুয়াশার ভেতর হঠাৎ গুলির শব্দ। আরিয়ান গাড়ি থামায়। পাশে মামী। আবার গুলি। এবার মামী’র কাঁধে লাগে। রক্ত। ভয়। ছুটে পালানো। আরিয়ান তাকে গাছের পেছনে নিয়ে যায়। “তুমি বলেছিলে তুমি বদলে গেছো… সত্যি কি?” মামী ফিসফিস করে, “আমি আর কারো ছায়া হতে চাই না… আমি নিজের আলোর জন্য লড়ছি।” আরিয়ান তার চোখে চেয়ে থাকে। যেন সত্য আর ছায়ার মধ্যেকার শেষ লড়াইটা এখন।

পাহাড়ের নিচে ঝর্ণার ধারে পাওয়া যায় একটি পুড়ে যাওয়া দেহ। পাশে পড়ে আছে আরিয়ান-এর ঘড়ি। পুলিশ আসে। সাঈদ ভাই চুপচাপ দেহটি দেখে বলেন, “লাশ শনাক্ত করা যাবে না। কিন্তু আমরা ধরে নিচ্ছি, এটা আরিয়ান।” মামী ফুঁপিয়ে কাঁদেন—নাকি অভিনয়? নিরব দূর থেকে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু একটি পুরনো ঘরে, পাহাড়ের গায়ে লুকিয়ে বসে থাকে এক লোক। মুখে ব্যান্ডেজ। হাত কাঁপছে। সে নিজেকেই বলছে, “শেষ হয়নি কিছুই। এবার আমি দেখবো, কে আসল আর কে ছায়া…”

আরিয়ান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। তার গালে হালকা কাটা দাগ, কপালে সেলাই, ঠোঁটে একপাশে কাটা। সে নিজেকে দেখে, যেন নিজেকে চিনতে পারছে না। চোখের নিচে কালো ছায়া, রাতজাগার ক্লান্তি, আর কিছু একটার খোঁজ। সামনে পুরনো কাঠের জানালা দিয়ে পাহাড়ি কুয়াশা গলে ঢুকে পড়ছে। এই কেবিনটাতেই তার দ্বিতীয় জীবন শুরু হয়েছে। এখানে সে একজন মৃত লোক। অথচ ভেতরে সে জ্বলছে—ভালোবাসা, প্রতারণা আর প্রতিশোধের ত্রিকোণ আগুনে। তুমি বেঁচে আছো, কারণ এখনো কিছু অসমাপ্ত রয়ে গেছে, কেবিনের দরজায় ভর দিয়ে বলেন সাঈদ ভাই। আরিয়ান পেছনে ঘুরে তাকায়। চোখে কোনো বিস্ময় নেই। শুধু জিজ্ঞাসা—“তোমরা জানো, কে করেছিল সবটা?” “আমরা জানি,” সাঈদ ভাই বলেন, “কিন্তু তুমি কি জানো, তুমি কোন চরিত্রটা এখন? প্রেমিক? শত্রু? না কি বিচারক?”

রিসোর্টের নির্জন বারান্দায় মামী দাঁড়িয়ে আছেন, গায়ে সাদা কাফতান, চুল খোলা, চোখে ক্লান্তি।

সামনে এসে দাঁড়ায় নিরব। মুখে আধহাসি, কিন্তু চোখে চাপা ভয়। “তুমি ভাবছো, আমি ফিরে গিয়ে সব বলে দেবো?” নিরব জিজ্ঞেস করে। মামী চুপ। “তুমি আর আমি একসঙ্গে যেটা শুরু করেছিলাম, ওটা তো আরিয়ান বদলে দিল। তুমি ওর প্রেমে পড়লে। কিন্তু প্ল্যানটা আমার ছিল, ভুলে গেছো?” মামী ধীরে বলেন, “তোমার প্ল্যান ছিল জাহেদুলকে সরিয়ে দিয়ে আমার পাশে বসা। আর আমার ছিল—নিজেকে রক্ষা করা।” নিরব রাগে ফুসে ওঠে। “তুমি জানো, আমি চাইলে ভিডিওটা এখনই ফাঁস করে দিতে পারি!” “মামী ফিসফিস করে বলে আর আমি চাইলে তোমার লাশটা ঝর্ণার নিচে ফেলে দিতে পারি” ঠোঁটে এক বিষাক্ত হাসি।


অফিসার শাহেদ ও সাঈদ ভাই রাতভর ভিডিও ফুটেজ, মোবাইল ট্র্যাকিং, এবং কন্ট্যাক্ট হিস্টোরি ঘেঁটে বিশ্লেষণ করছেন। সাঈদ ভাই বলেন, “আমরা যদি ওদের ছায়ার পেছনে ছুটি, কিছুই পাবো না। আমাদের দরকার ছায়ার মধ্যে আলো জ্বালানো। শাহেদ জানতে চায়। কীভাবে? “মামী ও নিরব—তারা ভাবছে ওরা সবাইকে চালাচ্ছে। কিন্তু এবার আমরা চালাবো… আরিয়ানের মাধ্যমে।”

মামী একটি নির্জন কেবিনে ঢোকে। ভিতরে আলো নেই, শুধু মোমবাতির নরম আলো। আরিয়ান সামনে দাঁড়িয়ে। মামী চমকে ওঠে। “তুমি…? আরিয়ান বলে বেঁচে আছি। গলায় ঠান্ডা তীব্রতা। মামী ধীরে এগিয়ে আসে। “তুমি সব জেনে গেছো? আরিয়ান বলে, “আমি শুধু জানতে চাই, তুমি সত্যিই আমাকে ভালোবেসেছিলে কি না।” মামী থেমে যায়। চোখ নামিয়ে ফেলে। তারপর বলে, “ভালোবাসা অনেক রকম হয়, আরিয়ান। কেউ বাঁচার জন্য ভালোবাসে, কেউ মরার জন্য।” আরিয়ান এগিয়ে আসে। “তুমি আমাকে সত্যি বললে, আমি সব ভুলে যাবো।” মামী বলে, “তাহলে শুনো—হ্যাঁ, আমি নিরবের সঙ্গে ছিলাম, প্রথমে। কিন্তু পরে… তুমি এসে সবকিছু পাল্টে দিয়েছিলে। আমি ভেঙে পড়ছিলাম। আমি শুধু একটা নিরাপদ জায়গা খুঁজছিলাম। তুমি ছিলে সেই জায়গা। কিন্তু… আমি ভুল করেছিলাম। আমি তোমায়… সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিলাম।” আরিয়ান একপলক তাকিয়ে থাকে। তারপর হঠাৎই মোমবাতি নিভে যায়।


পরদিন রিসোর্টের রান্নাঘরের এক কর্মীর মৃতদেহ পাওয়া যায়। গলায় চাপা দাগ। সে-ই ছিল সেই ব্যক্তি যে গোপনে গাড়ির নাম্বার লিস্ট করেছিল, যার কাছে ছিল একটি মোবাইল ক্লিপিং—মামী ও নিরবের কথোপকথনের অংশ। অফিসার শাহেদ জানেন—এই মৃত্যু “দুর্ঘটনা” নয়। এটা সময়মতো নিঃশব্দে মুখ বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা।


আরিয়ান নিজের মোবাইলে কপি করে নেয় নতুন একটা ভিডিও—যেখানে আছে মামী ও নিরবের গোপন পরিকল্পনার প্রমাণ। সে এটা ই-মেইল করে দেয় দুটি ঠিকানায়—একটা সাঈদ ভাইয়ের কাছে, আরেকটা সংবাদমাধ্যমের এক পরিচিত রিপোর্টারের কাছে। তবে একটাই শর্ত—“এই ভিডিওটা তখনই পাবলিশ হবে, যদি আমি পরবর্তী ৭২ ঘন্টায় কোনো সিগন্যাল না দিই।


এক রাতে নিরবকে ডাকে মামী। বলে, “আমরা শেষ করে ফেলি সবটা। ভিডিও ডিলিট করি। দেশ ছেড়ে যাই।” নিরব সন্দেহ করে, কিন্তু আসে। মামী তাকে একজোড়া ওয়াইন গ্লাস দেয়। দুজনে চুমুক দেয়। কিছুক্ষণ পর, নিরবের শরীর কাঁপে। তার মুখ থমকে যায়। চোখ লাল। শরীর নিস্তেজ হতে থাকে। মামী তাকিয়ে থাকে। ঠোঁটে হাসি। “তুমি ভেবেছিলে, আমি তোমার হাত ধরে বাঁচবো? না নিরব, আমি ছায়া ছিলাম… এখন আমি আগুন।”



এক পাহাড়ি কেবিন। বাইরে বৃষ্টি। ভেতরে আরিয়ান ও মামী মুখোমুখি। আরিয়ান পকেট থেকে বের করে দেয় সেই দ্বিতীয় পেনড্রাইভ। “এটাই শেষ সত্য, না কি এখনো কিছু বাকি?” মামী কাঁদে। “তুমি জানো, আমি আর কিছুই লুকাইনি। “তুমি নিরবকে মেরেছো,” আরিয়ান বলেন। মামী থেমে যায়। তারপর ধীরে মাথা নাড়ে। আমি শুধু ভালোবাসার জন্য সবকিছু করেছিলাম।“আর আমি সেই ভালোবাসার ভিতর পুড়ে শেষ হয়ে গেছি,” আরিয়ান বলে, তারপর টেবিল থেকে এক বোতল কেরোসিন ছুঁড়ে মাটিতে ছিটিয়ে দেয়। “তুমি কি জানো, ভালোবাসা যখন প্রতিশোধ হয়ে ওঠে, তখন সেটা ছায়া নয়, সেটা আগুন।” সে লাইটার ছুঁড়ে মারে মেঝেতে। আগুন ছড়িয়ে পড়ে। মামী চিৎকার করে ওঠে—“তুমি কি আমাকে মেরে ফেলবে?” আরিয়ান চুপচাপ এগিয়ে আসে, হাত বাড়িয়ে দেয়—“চলো, শেষবারের মতো বেরিয়ে আসি এই ছায়া থেকে।” মামী হাত ধরে। দুজন মিলে আগুন পেরিয়ে বেরিয়ে আসে।


---



“ভালোবাসা ছায়ার মতো, কখন যে পথ দেখায় আর কখন গিলে ফেলে… সেটা জানার আগেই, সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়।”


---


চলবে…

সবার কাছে একটা লাইক আশা করছি 

 #followers #foryoupageシ #facebookviral

Post a Comment

0 Comments